ইতিকথা
- কুমার সৌরভ ২৮-০৪-২০২৪

আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে
ভীরু হাতে বাবার কোমর পেঁচিয়ে
দ্বিতীয়বার যখন প্রবেশ করি আমার এ নিজস্ব শহরে
তখন আমি নিতান্তই বালক ।
প্রতিকূল আট মাসের প্রবাসী জলবায়ু-অমানবিক উদ্বাস্তু জীবন যাপনে
ততদিনে আমরা স্বজনহারা আর বিশীর্ণ পাতার মতো পান্ডুর ।
নিজ শহরে প্রবেশ মুহূর্তে আমাদের সেকি এক অভাবনীয় চেতনা
যেন মরুভূমির মতো কেউ শোষে নিচ্ছে সকল কষ্ট- বেদনা -আহাজারি
যাবজ্জীবন সাজা ভোগ শেষে ব্যাকুল ক্ষিপ্রতা নিয়ে
যেমন বেরিয়ে আসে কয়েদি কয়েদখানা থেকে
তেমনি ব্যাকুল ক্ষিপ্রতা নিয়ে আমরাও ছুটে এসেছি এ শহরে
আমার জন্মভূমিতে - আমাদের নিজস্ব আবাসে ।
আমার শ্রমজীবী পিতার বলিষ্ট হাত আঁকড়ে
সুরমা নদী পেরিয়ে শহরের ছোট্ট রাস্তা ধরে এগোনোর সময়
লোকালয়ের দু' পাশে ধ্বংস আর নিরবতার ধূসর ক্যানভাসে
গত ক'মাসের বিভত্‍সতা পৈশাচিকতার নগ্নরুপ দেখতে দেখতে একসময়
আমাদের পরিত্যক্ত বাসার সামনে পৌঁছে যাই
বাসার সামনে তখন আবর্জনার স্তুপ - বহুদিনের অযত্নের ছাপ
এসব মাড়িয়ে খোলা দরোজা দিয়ে আমরা ঘরে ঢুকলাম
সেখানে ধূ ধূ শূন্যতা
রেখে যাওয়া আসবাব বিছানাপত্র গেরস্থালি সামগ্রী কিছুই নেই
শূন্য ঘরে নির্বাক দাঁড়ানো বাবার চোখে জল
আদ্র কন্ঠে আমাকে বললেন
এ ঘর আমাদের-আমাদের পূর্বপুরুষের
বাবার স্থির মুখে তখন
ভাঙ্গা জানালা দিয়ে আসা এক চিলতে রোদ
সরল রেখার মতো থমকে দাঁড়িয়ে
বাইরে উঠোনের এক কোণে জলপাই গাছের ডালে বসা
এক ঝাঁক পাখি আকাশে উড়ে গেল তখনি
আমি তখন বাবার বক্ষলগ্ন হয়ে থরথর ।
মুহুর্তেই বাবা যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলেন
তার পেশিবহুল শ্রমিক হাত দুটি
বাসার যাবতীয় জঞ্জাল সাফ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল
কোন বিরাম নেই কোন বিশ্রাম নেই কোন ক্লান্তি নেই
নিজের শ্রমে-উদ্যমে সাজিয়ে তুলছেন আপন আবাস ।

সেই ঘর আছে এখনও আমিও আছি
বাবা গত হয়েছেন চার বছর
এ পঁচিশ বছরে আমাদের মফস্বল শহরে বদলে গেছে অনেক কিছু
বদলে গেছে মানুষ - মানুষের চেতনা
বদলে গেছে রাস্তাঘাট- বাড়ীঘর- প্রশাসনিক পরিচয়
থানার সামনের পুকুর এখন বিশাল বিপনী বিতান
নিরালা কবরস্তান পর্যন্ত গড়ে উঠেছে বসতি
আগে যেখানে আনসাররা বন্দুক চালনা শিখতো
সেই চানমারিতে এখন
মস্তবড় প্রশাসনিক অট্টালিকা আর বিচারালয়
বহু কুড়েঘর হয়েছে দালান
দালান মিশে গেছে মাটির সাথে
আর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঠেলায়
পাখির বাসার মতো ছোট্ট এ শহরে
এখন বেড়ে গেছে পয়সাওয়ালা বেনিয়ার দাপট
আরও বদলে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত অহংবোধ -সৃষ্টিশীলতা
কবিতার খাতায় বরং অনেক ভাল ঠিকাদারির হিসাব লিখা ।

এত বদলের টানাপোড়েনে আমার বয়স বেড়েছে আরও পঁচিশ
গতরে মগজে বাসা বেঁধেছে সময়ের ঘুনপোকা
নিরন্তর ক্ষয়ে ক্ষয়ে প্রতিবাদী জীবন
লুকিয়েছে আপোষকামিতার গহ্বরে
কেবলই মাটিতে মিশে যাওয়া আনত মাথা
কেবলই হাত কচলানো অনুগ্রহের দুয়ারে
কেবলই পরিচয়ের পালাবদল আর কেবলই হাহাকার ।

বাবার কথা মনে হয় এখন
চোখে ভাসে তার পেশীবহুল হাতের ওঠানামা
শ্রমের ভালবাসা দিয়ে বানানো ছোট্ট সংসারে
স্বপ্নের বুনটে বাঁধা সুরক্ষা প্রাচীর
আমাদের ভীরুতার কাছে আজ বন্দী হয়ে আছে ।

০৮ আগস্ট ১৯৯৬ .

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।